Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন

মুসলিম রেনেসাঁসের কবি ফররুখ আহমদের বসত ভিটা

ফররুখ আহমদ
Forrukh Ahmed

Home District: Magura, Sreepur

 

 

পারিবারিhttp://jessore.info/master/content_img/admin/images/Persons%20pic/PP%20Size%20photo/Farrukh-Ahmed.jpgক পরিচিতি:
মুসলিম রেনেসাঁর বাঙ্গালী কবি ফররম্নখ আহমদ ১৯১৮ সালের ১০ই জুন তৎকালীন যশোর জেলার মাগুরা মহকুমার শ্রীপুর থানার অন্তর্গত মাঝআইল গ্রামের বিখ্যাত সৈয়দ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা সৈয়দ হাতেম আলী এবং বেগম রওশন আখতার ছিলেন ফররুখ আহমদের স্নেহময়ী মাতা। কৈশোরেই তাঁর মাতৃবিয়োগ ঘটে।http://jessore.info/master/content_img/admin/images/Persons%20pic/PP%20Size%20photo/faruk_ahamed.jpg

প্রাচীন শিক্ষিত পরিবার হিসেবে গ্রামে তাঁদের ব্যাপক সম্মান ও খ্যাতি ছিল। ফররুখ আহমদের দাদা ছিলেন সহকারী চাকরিজীবী, দাদী তৎকালীন সময়ের শিক্ষিত জমিদার কন্যা। পিতা পুলিশ ইন্‌সপেক্টর।


শিক্ষাজীবন:
বাল্যকালে গ্রামের পাঠশালাতেই ফররুখ আহমদের শিক্ষাজীবনের হাতে খড়ি। পরবর্তীতে কলকাতায় এসে তালতলা মডেল এম. ই. স্কুলে ভর্তি হন। এরপর কলকাতার বিখ্যাত বালিগঞ্জ সরকারী হাইস্কুলে ভর্তি হন। ঐ সময় কবি গোলাম মোস্তফা বালিগঞ্জ সরকারী হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তিনি তাঁর ছাত্র কবি ফররুখ আহমদের কবিত্ব বিকাশে ব্যাপক উৎসাহ প্রদান করেন। পরবর্তীতে তিনি খুলনা জেলা স্কুলে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই ১৯৩৭ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৩৯ সালে তিনি কলকাতা রিপন কলেজ থেকে আই. এ পাস করেন। কলকাতা স্কটিশ চার্চ কলেজ ও সিটি কলেজেও পড়াশুনা করেছেন তিনি। আই. এ পাস করার পর প্রথমে তিনি দর্শন ও পরে ইংরেজীতে অনার্স নিয়ে বি. এ তে ভর্তি হন। ইংরেজী সাহিত্যে বেশ কিছু দিন অধ্যয়ন করলেও শেষ পর্যন্ত তাতে তিনি পরীক্ষা দিতে পারেননি।


পেশাগত জীবন:
দেশ বিভাগের পূর্ব পর্যন্ত কবি কলকাতায় ছিলেন। কলকাতায় থাকাকালীন তিনি আই. জি প্রিজন অফিস ও সিভিল সাপ্লাইতে অল্প সময়ের জন্যে চাকরি করেন। ১৯৪৫ সালে তিনি সাময়িকভাবে মাসিক ‘মোহাম্মদী’র সম্পাদকের দায়িত্বভার পালন করেন। জলপাইগুঁড়িতে একটি ফার্মেও কিছু দিন চাকরি করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের কিছুদিন পরে কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসেন। এখানে তিনি ঢাকা বেতারে ‘স্টাফ আর্টিস্ট’ হিসেবে যোগদান করেন। ঢাকা বেতারে তিনি ‘ছোটদের খেলাঘর’ অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন।

 
সাহিত্য কর্ম:
মুসলিম বাংলা সাহিত্যের আধুনিক কবি ফরররুখ আহমদের সাহিত্য অনুরাগ ও কাব্যপ্রীতি অল্প বয়স কাল থেকেই লক্ষ্যণীয় এবং তাঁর আত্নপ্রকাশ ছাত্র জীবনেই পরিলক্ষিত হয়। তাঁর লেখনী যেন সদ্য প্রস্ফূটিত একটি গোলাপী পদ্ম। হান্সা হেনার মত সুরভিত করেছে জগৎ ও জীবনকে। তাঁর প্রতিটি কাব্যে ফুটে উঠেছে মানব প্রেম ও অকৃত্রিম পল্লীরীতি। ১৯৪৪ সালে কবি বেনজির আহমদের অর্থানুকূল্যে ঊনিশটি কবিতার সমন্বয়ে তাঁর প্রথম কাব্য গ্রন্থ ‘সাত সাগরের মাঝি’ নামেই গ্রন্থটির নামকরণ করা হয়েছে। ‘সাত সাগরের মাঝি’ কবিতাটি তৎকালীন সময়ের একটি সার্থক রূপক কবিতা। ‘সাত সাগরের মাঝি’ কবিতা থেকে উদ্ধৃত কয়েকটি লাইন:

কত যে আঁধার পর্দা পারায়ে ভোর হ’ল জানি না তা।
নারঙ্গী বনে কাঁপছে সবুজ পাতা।
দুয়ারে তোমার সাতসাগরের জোয়ার এনেছে ফেনা।
তবু জাগলে না ? তবু তুমি জাগলে না ?
সাতসাগরের মাঝি চেয়ে দেখো দুয়ারে ডাকে জাহাজ,
অচল ছবি সে, তস্‌বির যেন দাঁড়ায়ে রয়েছে আজ।
হালে পানি নাই, পাল তার ওড়ে নাকো,
হে নাবিক ! তুমি মিনতি আমার রাখো:
তুমি উঠে এসো, তুমি উঠে এসো মাঝিমাল্লার দলে
দেখবে তোমার কিশ্‌তী আবার ভেসেছে সাগরজলে,
নীল দরিয়ায় যেন সে পূর্ণ চাঁদ,
মেঘ-তরঙ্গ কেটে কেটে চলে ভেঙ্গে চলে সব বাঁধ।
তবে তুমি জাগো, কখন সকালে ঝরেছে হাস্‌নাহেনা ’
এখনো তোমার ঘুম ভাঙলো না ? তবু তুমি জাগলে না ?

১৯৪৪ সালের দুর্ভিক্ষে কলকাতায় যখন লোক না খেয়ে মারা যেতে লাগলো তখন অত্যন্ত ব্যথিত হৃদয় কবি লিখলেন -----
“ জানি মানুষের নানা মুখ গুঁজে পড়ে আছে জমিনের পরে
সন্ধ্যার জনতা জানি কোন দিন রাখেনা সে মৃত্যুর খবর ”

ঢাকা বেতারে থাকাকালীন সময়ে তিনি বিভিন্ন নিবন্ধ, কবিতা ও সর্বোপরি অসংখ্য গান, হামদ, নাত, গজল লিখে রেডিওতে পরিবেশন করেছেন। সঙ্গীত বিষয়ে কবি ফররুখ আহমদের অগাধ জ্ঞান ছিল। তাঁর লিখিত গান গুলির মধ্যে কয়েকটি জনপ্রিয় গান:
•দ্বীন দুনিয়ার সাথী আমার নূরনবী হয়রত ---
•শুনেছি এ বাণী পথে ঊষার,
মান একতা শৃঙ্খলার।
•তোরা চাসনে কিছু কারো কাছে
খোদা --------  ছাড়া ।
•চাঁদ ছিল জেগে রাতের মিনারে প্রভাতের কিনারায় ।

বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা ‘মধুর চেয়ে মধুর যে ভাই আমার দেশের ভাষা ’ গানটি বিশেষ প্রশংসিত হয়েছিল। শিশুদের জন্যও তিনি অনেক গান রচনা করেছিলেন। তাঁর মধ্যে একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য গান:

ডালে ডালে পাখীর বাসা
মিষ্টি মধুর পাখীর ভাষা
সাত সাগরে নদীর বাসা
কুলুকুলু নদীর ভাষা।
হাজার সুরে হাজার ভাষায়
এ দুনিয়া ঘেরা
আর মাতৃভাষা বাংলা আমার
সকল ভাষার সেরা ।

বাংলা সাহিত্যের সার্থক রূপকার কবি ফররুখ আহমদের ‘হাতেম তা’য়ী’ কাব্যটি অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত এক অমূল্য সম্পদ। এখানে তিনি কবি মাইকেলকে সম্পূর্ণরূপে অনুস্মরণ করেননি। এ ক্ষেত্রে তাঁর লিখনীতে একটি অভিন্ন স্বতন্ত্রতা পরিলক্ষিত হয়েছে। ‘হাতেম তা’য়ী’ কাব্যটিকে বাংলার অনেক কবি সাহিত্যিক ‘মহাকাব্য ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। কবি এখানে পৌরাণিক উপমার আশ্রয় না নিলেও মুসলিম ঐতিহ্যের উপমা সম্ভার ভাষা ও ছন্দের মনোহারিত্বে বর্ণনা করেছেন। এ কাব্য বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। হাতেমতা’য়ী কাব্যের কিয়দাংশ:

যখন রক্তিম চাঁদ অন্ধকার তাজিতে সওয়ার
উঠে আসে দিগ্বলয়ে, ওয়েসিস নিস্তব্ধ, নির্জন,
দূরে পাহাড়ের চূড়া ধ্যান-মৌন; অজানা ইঙ্গিতে
তখনি ঘুমন্ত প্রাণ জেগে ওঠে। তখনি এ মনে
মরু প্রশ্বাসের সাথে জেগে ওঠে বিগত দিনের
দীর্ঘশ্বাস। আঁধো - আলো - অন্ধকারে দেখি আমি চেয়ে
বিস্মৃতির দ্বার খুলে উঠে আসে ঘুমন্ত স্মৃতিরা
রত্রির অস্পষ্ট পাখী দেখি আমি অজ্ঞাত বিস্ময়ে !

কবি ফরররুখ আহমদ লিখেছেন অবিরাম ধারায়, কবির কাব্যগ্রন্থ ‘সিরাজাম মুনিরা’ (১৯৫২), ‘নৌফেল ও হাতেম’ (১৯৬১ নাট্যকাব্য ), ‘মূহুর্তের কবিতা’ (১৯৬৩), ‘হাবেদা মরম্নর কাহিনী’ (১৯৮১) ও ‘সিন্দাবাদ’ (১৯৮৪) প্রকাশিত হয় ! শিশু কিশোরদের ছড়া ও কবিতা গ্রন্থ ‘পাখীর বাসা’ (১৯৬৫), ‘হরফের ছড়া’ (১৯৭০), ‘ছড়ার আসর’ (১৯৭০), ‘চিড়িয়াখানা’ (১৯৮০) প্রকাশিত হয়। এ ছাড়াও তাঁর আরো অনেক কাব্য গ্রন্থের অপ্রকাশিত পান্ডুলিপি রয়েছে।

কবির ছিল কবিতা প্রীতি। কবিতাকে তিনি ভালবাসতেন ছন্দের মহিমায়। তিনি ছিলেন গদ্য ছন্দে কবিতা লেখার বিরোধী পক্ষ। তাঁর ধারণা কবিতা মানেই মানুষের মনের ছন্দবদ্ধ কথা, ভাবনার কথা। সিন্দাবাদ কবিতায় তিনি লিখেছেন:

ভেঙ্গে ফেলো আজ খাকের মমতা আকাশে উঠেছে চাঁদ,
দরিয়ার বুকে দামাল জোয়ার ভাঙছে বালুর বাঁধ
ছিঁড়ে ফেলো আজ আয়েশী রাতের মখমল - অবসাদ,
নতুন পানিতে হাল খুলে দাও, হে মাঝি সিন্দাবাদ !

কবি ফররুখ আহমদ প্রথম জীবনে প্রখ্যাত মানবতাবাদী কমরেড এম. এন. রায়ের শিষ্য ছিলেন। কিন্তু জন্মসূত্রে ইসলামী আদর্শ ও ঐতিহ্যের অধিকারী কবি ফররুখ আহমদ বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে ধর্মীয় চিন্তায় নিমগ্ন হয়ে পড়েন। এর বহিঃপ্রকাশ তাঁর সাহিত্য কর্মের মধ্যে অন্তর্নিহিত। ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন সৎ, ধার্মিক, মানবতাবাদী ও অসাধারণ ব্যক্তিত্ববান কর্মপুরুষ।


কর্মের স্বীকৃতি স্বরূপ:
কবি ফররুখ আহমদ তাঁর অমর সৃষ্টির জন্যে সরকার ও বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক পেয়েছেন অনেক পুরস্কার  ও স্বীকৃতি। ১৯৬০ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট পুরস্কার ‘প্রাইড অব পারফরমেন্স’ (Pride of performance) ও ‘বাংলা একাডেমী পুরস্কার’ লাভ করেন। ১৯৬৬ সালে ‘হাতেমতায়ী’ গ্রন্থটির জন্যে ‘আদমজী পুরস্কার’ এবং একই বছর তাঁর ‘পাখীর বাসা’ গ্রন্থটির জন্যে ‘ইউনেস্কো পুরস্কার’ পান।

মরণোত্তর বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ১৯৭৭ সালে ‘একুশে পদক’ এবং ১৯৮০ সালে "স্বাধীনতা পুরস্কার’ প্রদান করেন। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক কবিকে ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশন পুরস্কার’ প্রদান করা হয়।


ব্যক্তিগত জীবন:
১৯৪২ সালে কবি তাঁর আপন খালাতো বোন সৈয়দা তৈয়েবা খাতুনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।


পরলোক গমন:
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে কবি ফররুখ আহমদের মৃত্যু এক অভাবনীয় শূন্যতা সৃষ্টি করেছে। এই অভিমানী কবি চরম দারিদ্র্যতার মধ্যে চিকিৎসার অভাবে পরম পৌরুষত্বের সাথে ১৯৭৪ সালের অক্টোবর মাসের ১৯ তারিখে ছাপ্পান্ন বছর বয়সে নিয়তি নির্ধারিত মৃত্যুকে বরণ করেন।

দেশ স্বাধীন হবার পর কিছু স্বার্থান্বেষী মহল তাঁর প্রতি চরম অবহেলা ও উদাসীনতা প্রদর্শন করলেও বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে তিনি প্রতিভার যে উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে গেছেন তা যুগ যুগ ধরে বাঙ্গালী জাতির জীবনে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।



তথ্য সূত্র:
যশোরের যশস্বী, শিল্পী ও সাহিত্যিক
লেখক : কাজী শওকত শাহী

 

কিভাবে যাওয়া যায়:

এটি এ উপজেলার নাকোল ইউনিয়নে অবস্থিত। উপজেলা সদর থেকে পাঁকা সড়ক যোগে গ্রামবাংলা অটো, প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেল যাওয়া যায়। মাগুরা সদর ভায়নার মোড় হতে যে কোন যানবাহনে ওয়াবদা হয়ে কবি বাড়ী যাওয়া য়ায়।